প্রতিবেদক, ক্যাম্পাস মিরর প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার , ২৭ নভেম্বর , ২০২৫
ঢাকার পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা তিনটি পৃথক মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ২২ জনের দণ্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
দুদকের দায়ের করা এই তিন মামলার প্রতিটিই পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিস্বার্থে সরকারি সম্পদ বণ্টন ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগে করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড
পৃথক তিন মামলায় শেখ হাসিনাকে সাত বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তিন মামলায় তাঁকে এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। আর অর্থদণ্ড অনাদায়ে প্রতিটি মামলায় ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জয় ও পুতুলের ৫ বছর করে দণ্ড
একটি মামলায় শেখ হাসিনার ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পাশাপাশি তাঁকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। অর্থদণ্ড অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরেক মামলায় শেখ হাসিনার মেয়ে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রেও এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বাকি ১৯ আসামি : কেউ দণ্ড, কেউ খালাস
এই তিন মামলায় মোট আসামি সংখ্যা ছিল ৪৭। তবে একই ব্যক্তির নাম একাধিক মামলায় থাকায় প্রকৃত আসামি ছিলেন ২২ জন। তাঁদের মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা রয়েছেন। একজন আসামি তিন মামলাই খালাস পেয়েছেন। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার। অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাঁকে খালাস দেন।
রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ছিলেন তিন মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি। তিন মামলায় তাঁকে এক বছর করে মোট তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তিন মামলায় মোট ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করেছেন বিচারক। রায় ঘোষণার সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং রায় শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রতিমন্ত্রী–সচিবসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দণ্ড
মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। তাঁকে তিন মামলায় ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মোট তিন লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে দেড় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারকে তিন মামলায় ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিনকেও একইভাবে তিন মামলায় ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছেন বিচারক।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞাকে পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে তাঁকে নয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন দুই মামলায় মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, মোট দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন।
আরও যেসব কর্মকর্তা দণ্ডিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন—
রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন–তিন মামলায় মোট ৯ বছর কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী–তিন মামলায় মোট ৯ বছর কারাদণ্ড।
গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার–তিন মামলায় মোট ৩ বছর কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস–দুই মামলায় মোট ৬ বছর কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলাম–দুই মামলায় মোট ৬ বছর কারাদণ্ড।
রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ–এক মামলায় ৩ বছর কারাদণ্ড।
পরিচালক (এস্টেট–২) শেখ শাহিনুল ইসলাম–এক মামলায় ৩ বছর কারাদণ্ড।
পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম–এক মামলায় ৩ বছর কারাদণ্ড।
সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান, মো. হাবিবুর রহমান সবুজ, নায়েব আলী শরীফ ও মাজহারুল ইসলাম–বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও জরিমানা।
গত জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে ছয়টি মামলা করে। অভিযোগ ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের অনিয়মিতভাবে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। মামলার তালিকায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ছাড়াও শেখ রেহানা, তাঁর মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ আরও অনেকে ছিলেন।
এই ছয় মামলার মধ্যে তিনটির রায়ের মাধ্যমে বড় এক অধ্যায়ের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলো। বাকি তিন মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
১৭ নভেম্বর তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। ৩১ জুলাই আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আজ (২৭ নভেম্বর) রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয় এবং নির্ধারিত দিনেই রায় দেওয়া হলো।
রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, তদন্তকারী কর্মকর্তা উপস্থাপিত নথি, সাক্ষ্য এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
পূর্বাচলের বহুল আলোচিত প্লট বরাদ্দ দুর্নীতির এই তিন মামলার রায় বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার বড় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ রাজনীতিক ও আমলাদের বিরুদ্ধেও আইন সমভাবে প্রযোজ্য—এটি আদালত আবারো স্পষ্ট করে দিল।