বিশেষ প্রতিনিধি, ক্যাম্পাস মিরর প্রকাশিত: মঙ্গলবার , ১৮ মার্চ , ২০২৫
ভারতে বসে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন আর ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়ে মন্তব্য করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড।
তুলসী নাম এবং একনিষ্ঠভাবে ধর্ম পালন করা হিন্দু হওয়ার কারণে অনেকেই তাকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে ধারণা করে থাকেন। তবে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত নন। তার জন্ম ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামোয়ায়। বয়স ৪৩ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম এই হিন্দু কংগ্রেস সদস্য ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান একনিষ্ঠভাবে পালনের পাশাপাশি হিন্দুদের অধিকার নিয়েও বেশ সরব।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি তার হিন্দুত্ববাদের প্রচারের বিষয়টি গত নভেম্বরে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল বিবিসি বাংলা।
১৯৮৩ সালে তুলসী গ্যাবার্ডের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্যে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে। তার মা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তার বাবা রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। হিন্দু ধর্মে অনুরাগের কারণে গ্যাবার্ডের মা সন্তানের হিন্দু নাম রাখেন।
তুলসী গ্যাবার্ড হাওয়াই থেকে ২০১৩ সালে প্রথমবার এমপি হিসাবে নির্বাচিত হন। ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন তিনি। রাজনীতি ছাড়াও দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তুলসী। ইরাক ও কুয়েতের মতো দেশেও ওই সময় মোতায়েন ছিলেন তিনি।
২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছেড়েছিলেন তুলসী। তার আগে ২০২০ সালে বাইডেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়েও তিনি শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছিলেন তুলসী।
প্রথমে তিনি স্বতন্ত্র হিসাবে নাম নিবন্ধন করেছিলেন। পরে ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন তুলসী। চলতি বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারাভিযানে সাহায্য করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেইনকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিরোধিতা করেছিলেন তুলসী। সেই জায়গা থেকে তার নতুন দায়িত্ব তাকে কোন পথে নিয়ে যায় সবার নজর সেদিকে।
তুলসীর বাবা মাইক গ্যাবার্ডও ছিলেন রাজনীতিবিদ। তিনি রিপাবলিকান থেকে ডেমোক্র্যাটদের দিকে চলে গিয়েছিলেন। ছিলেন সেনেটারও।
গত নভেম্বরে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ডনাল্ড ট্রাম্প যখন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসাবে তুলসী গ্যাবার্ডকে বেছে নেন, তখন বাংলাদেশে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলন চলছিল।
ভগবত গীতার যে কপিতে হাত রেখে কংগ্রেস সদস্য হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন, সেটি নরেন্দ্র মোদীর হাতে তুলে দেন তুলসী গ্যাবার্ড
তুলসীর বিজেপি ঘনিষ্ঠতা
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে বিয়ে করেন তুলসী গ্যাবার্ড। সেই সময় তার বিয়ে নিয়ে ভারতে বিস্তর আলোচনাও হয়েছিল। কারণ, বৈদিক রীতি অনুযায়ী হাওয়াইয়ে সিনেমাটোগ্রাফার আব্রাহাম উইলিয়ামসকে বিয়ে করেছিলেন গ্যাবার্ড।
‘দ্য ক্যারাভান’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তরণজিৎ সান্ধু ও রাম মাধব।
সেই সময় রাম মাধব ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র ছিলেন। এর আগে রাম মাধব দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) জাতীয় মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানে রাম মাধব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি ব্যক্তিগত বার্তা পড়ে শুনিয়েছিলেন এবং একটা গণেশের মূর্তি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।
বিয়ের কয়েক মাস আগে প্রথমবারের জন্য ভারত সফরে এসেছিলেন গ্যাবার্ড। তিন সপ্তাহব্যাপী এই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদী, তৎকালীন ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যাপক প্রশংসা করতে শোনা গিয়েছিল তাকে।
তিনি বলেছিলেন, “মোদী একজন খুবি শক্তিশালী নেতা এবং তিনি ভারতকে কোন পথে নিয়ে যেতে চান সেই বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ। তিনি এমন একজন নেতা, যার ভারতের জন্য প্ল্যান অফ অ্যাকশান (নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পরিকল্পনা) রয়েছে।”
শুধু তাই নয়, একটা স্কুল ঝাড়ু দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছতা অভিযানের প্রতি সমর্থনও দেখিয়েছিলেন তুলসী গ্যাবার্ড।
বিশ্বের মঞ্চে যোগাসনকে তুলে ধরার প্রধানমন্ত্রী মোদীর যে প্রয়াস, সেখানেও গ্যাবার্ডকে দৃঢ় সমর্থন করতে দেখা গিয়েছে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। উপহার হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ছেলেবেলা থেকে তার কাছে থাকা ভগবত গীতা দিয়ে জানিয়েছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন থাকার সময় এরই (ভগবত গীতার) আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কংগ্রেসন্যাল হিসাবে শপথ নেওয়ার সময়েও এই গীতার শপথ নেন তিনি।
২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সমর্থন করে আসছেন গ্যাবার্ড। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যখন মার্কিন সরকার তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল, সরকারের সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর কয়েকজন নেতার মধ্যে তুলসী গ্যাবার্ডও ছিলেন।
হিন্দু পরিচয়ে সোচ্চার
২০১৯ সালে, তুলসী গ্যাবার্ড তার হিন্দু পরিচয় সম্পর্কে ‘রিলিজিয়ন নিউজ সার্ভিস’-এর জন্য একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, হিন্দু হিসাবে গর্ববোধ করলেও তিনি ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ নন।
তিনি লিখেছেন, “আমার বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই অভিযোগের প্রমাণ হিসাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতার সঙ্গে আমার বৈঠককে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হিলারি ক্লিনটন এবং কংগ্রেসে আমার অনেক সহকর্মীই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বা তার সঙ্গে কাজ করেছেন।”
গ্যাবার্ডের যুক্তি দিয়েছিলেন খ্রিষ্টান, মুসলিম, ইহুদি, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের থেকে তিনি যে সমর্থন পেয়েছেন সেটাই তার অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ।
২০২০ সালে তিনি এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছিলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, হিন্দুফোবিয়া একটা বাস্তব চিত্র। কংগ্রেসের হয়ে আমার প্রতিটি প্রচারে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই লড়াইয়ে আমি তা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি। আমাদের দেশে হিন্দুরা প্রতিদিন কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় এটা তার একটা উদাহরণ মাত্র। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মিডিয়া এটা শুধু সহ্যই করে না, প্রচারও করে।”
অনেক অনুষ্ঠানে তাকে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতা নিয়ে কথা বলতে ও ভজন গাইতে দেখা গেছে। প্রথমবার সংসদে পৌঁছে গীতার শপথ নিয়েছিলেন তিনি।
শপথ নেওয়ার পর তুলসী বলেছিলেন, ভগবত গীতা আমাকে দেশ ও অন্যদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে।
বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন আগেও
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ির মধ্যে তুলসী গ্যাবার্ডের একটি পুরোনো ভিডিও ফেইসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
সেটাকে সাম্প্রতিক বক্তব্য হিসাবে উল্লেখ করা হলেও ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট বুম বাংলাদেশ অনুসন্ধান করে দেখায়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তুলসী গ্যাবার্ড নিজের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে ওই ভিডিওটি প্রকাশ করেছিলেন ২০২১ সালের ২ এপ্রিল। তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা ও ক্ষমতায় ছিল তার দল আওয়ামী লীগ।
২০২১ সালে দুর্গা পুজোর সময় বাংলাদেশে সহিংসতা দেখা যায়। শতাধিক হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সেই সময় বহু হিন্দু মন্দির, বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এই আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) ওই ভিডিও বার্তায় গ্যাবার্ড বলেছিলেন “বাংলাদেশের মন্দিরে ভগবানের ভক্তদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা ও সহিংসতা দেখে আমার মন ভেঙে গিয়েছে। জিহাদিদের এই বিশ্বাস, যে মন্দির ও মূর্তি জ্বালিয়ে দেওয়া এবং নষ্ট করলে তাদের ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন, আসলে দেখায় যে তারা ঈশ্বর থেকে কতটা দূরে।
“বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের কাছে সময় এসেছে যে তারা হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধসহ সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঘৃণার জিহাদি শক্তির হাত থেকে রক্ষা করুক।”
বিবিসি বাংলা ওই সময় এক প্রতিবেদনে বলেছিল, এর আগে তুলসী গ্যাবার্ড সংসদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। সেই সময় তিনি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নৃশংসতার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দায়ী করেন।
গণআন্দোলনে ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ভারত সরকার; সংখ্যালঘু ইস্যুতে ইউনূস সরকারকে চাপের রাখার কৌশল নেয় তারা। এ সময় ভারতীয় মিডিয়ার বিরুদ্ধে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে’ গুজব ছড়ানোর অভিযোগ করেছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনে নতুন পদে তুলসীর আসার খবরে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীদেরকে। তাদের সেই উল্লাসে শামিল হয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে বেড়ানো আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালানোর বিপরীতে তারা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে, জো বাইডেন প্রশাসনের সহায়তায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েনের এই সময়ে ইউনূস সরকারকে ‘অপসারণে’ ভূমিকা রাখবেন ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এবং বিজেপি ঘনিষ্ঠরা।
যেখানে অগ্রণী ভূমিকা হবে গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের। একইসঙ্গে, এফবিআইয়ের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধান কাশ প্যাটেলও ইউনূসকে হটাতে ভূমিকা রাখবেন বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে তারা।