প্রতিবেদক, ক্যাম্পাস মিরর প্রকাশিত: রবিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি , ২০২৫
ছবি: কালের কন্ঠের সৌজন্যে
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর গত ২১ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন যার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে।
তার ওই আদেশে মার্কিন মদদপুষ্ট এনজিও প্রকল্পগুলোর আর্থিক বরাদ্দ বাতিল কিংবা স্থগিত হয়ে যায়।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সহযোগিতা কার্যক্রম স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএসএআইডি। গত ২৫ জানুয়ারি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এসংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২১ জানুয়ারি এ বিষয়ে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এরপর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সহায়তা ছাড়া ইউএসএআইডির বাকি সব কার্যক্রম তিন মাসের জন্য গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে বাংলাদেশের প্রায় ৩২৭ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ১০ হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ একাধিক সহায়তা কার্যক্রম ঝুঁকিতে।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরো সূত্র জানায়, দেশের ২৭৪টি এনজিও বিভিন্ন দেশ থেকে তহবিল (ফান্ড) পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশে যেসব এনজিও ইউএসএআইডির অনুদান পেতো সেই অনুদানের প্রেক্ষিতে তারা কর অব্যাহতি সুবিধাও পেত। অনুদান বন্ধ হওয়ার পর কর অব্যাহতিও নিয়ম অনুযায়ী বন্ধ হয়ে গেছে।
এর মধ্যে ইউএসএআইডির ফান্ড পেত ৮৭টি এনজিও। এসব ডোনার এজেন্সির (দাতা সংস্থা) মাধ্যমে দেশে প্রায় ২৪০টি এনজিওর প্রকল্প পরিচালিত হতো। সেই হিসাবে ৩২৭টি এনজিওর ইউএসএআইডির ফান্ড স্থগিত হয়েছে।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৮৭টি ডোনার এজেন্সি ইউএসএআইডির ফান্ড নিত।
তারা অন্যান্য লোকাল এনজিওর মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করত। আপাতত তাদের তিন মাসের ফান্ড স্থগিত করা হয়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। সেবাগ্রহীতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
এনজিওসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ৩২৭টি এনজিওর ইউএসএআইডির ফান্ডে ১০ হাজারের বেশি কর্মী সরাসরি চাকরি করতেন, যাদের সবাই বেকার হয়েছেন।
এসব কর্মীর বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করায় তারা কোনো আর্থিক সুবিধাও পাননি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ, জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে লাখ লাখ প্রান্তিক মানুষ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে। তবে আমাদের দেশে উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রভাব বেশি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মূলত একটি গবেষণা সংস্থা। এই সংস্থায় ইউএসএআইডির অর্থায়নে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তারা এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতির চিঠি দিয়েছে। স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের তিন মাসের সময় দিয়ে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর অস্থায়ীদের শর্তানুযায়ী অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে ইএসএআইডি হোস্ট অ্যান্ড ইমপ্যাক্টেড কমিউনিটি রেজিল্যান্স অ্যাকটিভিটি, বাংলাদেশ নামের একটি এনজিওর কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি অন্য একটি স্থায়ী চাকরি ছেড়ে মাত্র তিন মাস আগে কিছুটা সিনিয়র পজিশনে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। নতুন প্রতিষ্ঠানে আমার চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। এ অবস্থায় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার চাকরি আর থাকছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অথই সাগরে পড়ে গেলাম।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সহকারী পরিচালক শাহিনা পারভীন বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ডে আমাদের একটি প্রজেক্ট চলত। সেখানে ১৯ জন কর্মী ছিলেন। তাদের সবাইকে বাদ দিতে হয়েছে।
ইউথ রাইজের কর্মকর্তা গৌতম ঘোষ বলেন, “আমি এই প্রতিষ্ঠানে গত ২৩ জানুয়ারি যোগ দিয়েছি। এর দুই দিনের মাথায়ই ফান্ড বন্ধের খবর পেলাম। এই প্রজেক্টে ২০ জনের মতো কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে ১২ জনের তাত্ক্ষণিকভাবে চাকরি গেছে। আর আমরা আটজন ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেতন পাব।”
কর্মসূচির পরিধি ও কর্মীদের বিপুল সংখ্যার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি ও অলাভজনক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক। বাংলাদেশভিত্তিক সংস্থাটির কাজ রয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশসহ চারটি দেশে ৯টি কর্মসূচি স্থগিত করেছে ব্র্যাক।
নাম প্রকাশ না করে একটি এনজিওর প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কর্মী ও সুবিধাভোগীরা। এর বাইরে যেসব গবেষণা কার্যক্রম চলত, সেগুলোর ক্ষতি হবে দীর্ঘমেয়াদি। তবে তিন মাস পর যদি ফান্ড চালুও হয়, তাহলে তা এক-তৃতীয়াংশে চলে আসবে। এতে আগে যদি সাতটি খাতে ফান্ডিং হতো, এখন সেটা দুটি খাতে চলে আসবে। এটা হলে অন্য ডোনাররাও একই পথ অনুসরণ করবে। এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বড় ধরনের বাধার মুখে পড়বে।”
সহায়তা বন্ধ করছে সুইজারল্যান্ড : বাংলাদেশসহ তিন দেশে উন্নয়ন কর্মসূচিতে সহায়তা বন্ধ করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড সরকার। অন্য দুটি দেশ হলো আলবেনিয়া ও জাম্বিয়া। গত ২৯ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম সুইস ইনফোর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক সহায়তার জন্য সুইস সরকার যে পরিমাণ অর্থ চেয়েছিল, তার চেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন দেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুইজারল্যান্ডের সরকার। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) ২০২৮ সালের পর বাংলাদেশ, আলবেনিয়া ও জাম্বিয়ায় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন কর্মসূচি বন্ধ করে দেবে।
ইউএসএআইডির অবদান : ইউএসএআইডি গত ৫০ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। তাদের অনুদান পাওয়া অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। ইউএসএআইডি গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২৬ সালের জন্য বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি (ডেভেলপমেন্ট অবজেকটিভ গ্র্যান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হয়। এর মাধ্যমে ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ইউএসএআইডি।