প্রতিবেদক, ক্যাম্পাস মিরর প্রকাশিত: শনিবার , ১৬ আগস্ট , ২০২৫
বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ দিন দিন আরও দীর্ঘ ও তীব্র হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই চরম গরম কেবল শারীরিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে না, বরং মানব মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ওপরও ফেলছে গুরুতর প্রভাব। বিশেষত, যাদের আগে থেকেই স্নায়বিক সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য গরম আবহাওয়া হয়ে উঠছে ভয়ংকর।
পাঁচ মাস বয়সেই জেকের প্রথম খিঁচুনি শুরু হয়। তার মা স্টেফানি স্মিথ জানান, প্রচণ্ড গরমে শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে খিঁচুনি দেখা দেয়। পরে তার রোগ ধরা পড়ে—ড্রাভেট সিনড্রোম, যা এক ধরনের বিরল এপিলেপসি। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন বা গরমে সহজেই খিঁচুনি আক্রান্ত হয়। আজ ১৩ বছর বয়সী জেক প্রতি গ্রীষ্মেই অগণিত খিঁচুনির শিকার হচ্ছে। “প্রচণ্ড গরমের গ্রীষ্ম এখন আমাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা,” বলেন তার মা।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় সিসোদিয়া জানান, গরম আবহাওয়া অনেকগুলো স্নায়ুবিক রোগকে আরও খারাপ করে তোলে। তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন কেন মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করবে না? শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মস্তিষ্কই মুখ্য ভূমিকা রাখে।” তার গবেষণায় দেখা যায়, এপিলেপসি ছাড়াও স্ট্রোক, এনসেফালাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, মাইগ্রেনসহ বিভিন্ন রোগ তীব্র গরমে বাড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৩ সালের ইউরোপীয় তাপপ্রবাহে অতিরিক্ত মৃত্যুর প্রায় ৭% ছিল সরাসরি স্নায়ুবিক সমস্যাজনিত। ২০২২ সালের যুক্তরাজ্যের তাপপ্রবাহেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
মানব মস্তিষ্কের গড় তাপমাত্রা সাধারণত শরীরের তাপমাত্রার থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় না। কিন্তু চিন্তা ও প্রতিক্রিয়ায় মস্তিষ্ক নিজেই প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। এজন্য রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে তাপ অপসারণ অত্যাবশ্যক। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ও বার্তা প্রেরণকারী অণুগুলো তাপমাত্রা সংবেদনশীল; অতিরিক্ত গরমে এগুলো সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
তীব্র গরমে সবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা ও মেজাজে পরিবর্তন আসে। তবে যাদের স্নায়ুবিক রোগ আছে, তাদের প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক হয়। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে আক্রান্তদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হয়। আবার কিছু মানসিক রোগের ওষুধ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত করে, ফলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
ঘুমের ব্যাঘাতও অন্যতম বড় সমস্যা। রাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলে ঘুম কম হয়, যা এপিলেপসির ঝুঁকি বাড়ায়। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত প্রবীণদেরও তাপপ্রবাহে মৃত্যু বাড়তে দেখা গেছে। তারা তৃষ্ণা বুঝতে না পারা, জানালা বন্ধ না করা কিংবা অযথা বাইরে বের হওয়ার মতো ভুল করে ফেলেন।
স্ট্রোকের ক্ষেত্রেও তীব্র গরমের প্রভাব স্পষ্ট। ২৫টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিদিনের গরমে বাড়তি মৃত্যুর হার ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে মারা যায়, এর মধ্যে গরম অতিরিক্ত ১০ হাজার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশেষত মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই ঝুঁকি অনেক বেশি।
এছাড়া চরম গরম গর্ভবতী নারীদের জন্যও হুমকি। গবেষণায় দেখা গেছে, তাপপ্রবাহ প্রি-টার্ম জন্ম ২৬% পর্যন্ত বাড়ায়, যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে সমস্যা তৈরি করে। একই সঙ্গে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ যেমন জিকা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া, যা স্নায়ুবিক জটিলতা তৈরি করতে পারে।
গরমের কারণে মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হয়, ফলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া ওষুধের কার্যকারিতাও নষ্ট হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজছেন—কোন বিষয় সবচেয়ে ক্ষতিকর : সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, তাপপ্রবাহের দীর্ঘতা নাকি রাতের গরম? তবে ঝুঁকিপূর্ণদের চিহ্নিত করা এখন জরুরি। এর জন্য আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা ও সুরক্ষা কৌশল তৈরি করা দরকার।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “গ্লোবাল ওয়ার্মিং শেষ, শুরু হয়েছে গ্লোবাল বয়লিংয়ের যুগ।” তীব্র গরমের এই নতুন বাস্তবতায় মানব মস্তিষ্কের জন্য আসছে আরও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ।